ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয় - ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ - ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা
বর্তমানের আধুনিক যুগে যান্ত্রিক সভ্যতা যে সমস্ত ভয়াবহ সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম একটি সংকট হলো পরিবেশ দূষণ আর এই নোংরা পরিবেশ থেকে জন্ম নিচ্ছে এক ধরনের ভয়ানক রোগ জীবাণু বহনকারী ক্ষুদ্র একটি পতঙ্গ যার নাম এডিস মশা। আর এই মশার মাধ্যমে যে রোগটি হয় তার নাম হলো ডেঙ্গু জ্বর। প্রতি বছর এই ডেঙ্গু জ্বর শত শত মানুষের প্রাণ ছিনিয়ে নেয়। তাই আজকে আমরা ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয় , ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ এবং ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা সম্পর্কে জানব।
সূচিপত্রঃ ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয় - ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ - ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা
- ডেঙ্গু জ্বর কি
- এডিস মশার পরিচয়
- ডেঙ্গু জ্বরের উদ্ভব ও বিস্তার
- ডেঙ্গু জ্বরের প্রকারভেদ
- ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
- ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা
- ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয়
ডেঙ্গু জ্বর কি
ডেঙ্গু জ্বরের নাম আমরা অনেকেই শুনেছি , বিশেষ করে বর্ষাকালে এই রোগটির
প্রাদুর্ভাব মারাত্মক আকারে দেখা দেয়। তাই এর সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান রাখা
আমাদের প্রয়োজন। ডেঙ্গু জ্বর কি এই বিষয়টি অনেকেরই অজানা। তাই চলুন আজকে জেনে
নেওয়া যাক ডেঙ্গু জ্বর কি। সাধারণত ডেঙ্গু জ্বর হলো একটি ভাইরাস সংঘটিত সংক্রামক
ব্যাধি। মানবদেহে ডেঙ্গু ভাইরাস আক্রমণ জনিত ক্লাসিক্যাল বা হিমোরেজিক
জাতীয় তীব্র শারীরিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার নামে ডেঙ্গু জ্বর। এই রোগে ছড়ানোর
প্রধান বাহক হচ্ছে এডিস নামক এক ধরনের মশা। তাই ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এদিস মশা
সম্পর্কেও আমাদের সকলের জেনে নেওয়া অত্যন্ত জরুরী।
এডিস মশার পরিচয়
উপরের অংশে আমরা জানতে পেরেছি যে ডেঙ্গু নামক ভয়াবহ এই জ্বরের বাহক হল এডিস নামক
মশা। ডেঙ্গু জ্বরের পাশাপাশি মশার পরিচয় জানাও আমাদের জন্য জরুরী। তাই আজকে আমরা
পরিচয় সম্পর্কেও জানবো। চলুন তাহলে আর দেরি না করে এদিক মশার পরিচয় জেনে নেওয়া
যাক। এডিস মশা দেখতে গাড়ো নীলাভ কালো রঙের । এ মশার সারা শরীরে সাদা কালো
ডোর কাটা দাগ আছে। পা গুলো একটু লম্বাটে ধরনের । এডিসে এজিইপটাই এবং এডিস
এলোপিটাস নামক দুই ধরনের স্ত্রী মশা ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস বহন করে থাকে । এডিস
মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায় , বিশেষ করে সকাল বেলার প্রথমদিকে ও বিকাল
বেলার সেই এই মশা বেশি কামড়ায়। মশা মানুষের তৈরি মাটি ও চিনা মাটির পাত্রে ,
পড়ে থাকা টায়ারে , চিপসের প্যাকেটে , প্লাস্টিকের বোতল ইত্যাদি পানি জমে থাকার
মত স্থানে ডিম পাড়ে এবং বংশবৃদ্ধি করে। ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস বাহিরে মশা
জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি।
ডেঙ্গু জ্বরের উদ্ভব ও বিস্তার
এবার আমরা জানবো ডেঙ্গু জ্বরের উদ্ভব ও বিস্তার সম্পর্কে । কিভাবে এবং কবে ডেঙ্গু জ্বর চিহ্নিত করা হয় সে বিষয়ে আপনার জানা না থাকলে বিষয়টি জেনে নিতে পারেন। চলুন তাহলে এবার ডেঙ্গু জ্বরের উদ্ভব ও বিস্তার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় সর্ব প্রথম এডিস মশা শনাক্ত হয়। এ সময় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শনাক্ত হয় এডিস মশা। ১৯৪৪ সালে ড. আলবার্ট মার্টিন ডেঙ্গু ভাইরাস আবিষ্কার করেন। তখন বলা হয় দুই জাতির এডিট মশা দ্বারা ডেঙ্গি ভাইরাস ছড়ায় , দ্বিতীয়বারের মতন বাংলাদেশে ১৯ ৩০ সালে থাইল্যান্ডের একদল বিশেষজ্ঞ দল ডেঙ্গু জ্বর সনাক্তকরেণ। তারা 'ঢাকাইয়া জ্বর' নামে পরিচিতজনকে ডেঙ্গু জ্বর বলে আখ্যায়িত করেন। বাংলাদেশ ছাড়াও এর আশেপাশে থাকা প্রতিবেশী দেশগুলো যেমন- ভারত , নেপাল , মায়ানমার ইত্যাদি দেশগুলোতেও ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর ভাব দেখা যায়
ডেঙ্গু জ্বরের প্রকারভেদ
চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক ডেঙ্গু জ্বরের প্রকারভেদ সম্পদ। কারণ ডেঙ্গু জ্বর বেশ
কয়েক ধরনের হতে পারে এই জন্য ডেঙ্গু জ্বরের প্রকারভেদ সম্পর্কে আমাদের জেনে
নেওয়া দরকার। ডেঙ্গু জ্বর এডিস মশা বাহিত এক ধরনের এন এ ফ্যাবি ভাইরাসজনিত তীব্র
জ্বর। এডিস মশাবাহিত এই ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে যথা
- ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর
- হেমোরিজিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর
ডেঙ্গু জ্বর প্রধানত দুই প্রকারের হলেও ডেঙ্গু ভাইরাসের মোট চারটি সেরোটাইপ
রয়েছে। নিচে এই ভাইরাসের টাইপ গুলোর নাম উল্লেখ করা হলো,
- DNA - 1
- DNA - 2
- DNA - 3
- DNA - 4
তবে এর মধ্যে অত্যন্ত মারাত্মক ভাইরাস দুইটি যথা ,DNA - 2 ,DNA - 3।হেমোরেজিক
ডেঙ্গু জ্বরের জন্য মূলত এই দুই ভাইরাসই দায়ী।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
ডেঙ্গু জ্বর যেহেতু ভাইরাস বাহিত একটি মারাত্মক রোগ এবং এর প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি
আর এই রোগের কোন বয়স নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই, এই কারণে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ গুলো
আমাদের জেনে রাখা উচিত। যাতে করে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ গুলো শরীরে প্রকাশ
পেলে অনতিবিলম্বে আমরা ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পারি। তাই চলুন ডেঙ্গু জ্বরের
লক্ষণগুলো এবার আমরা জেনে নেব। আমরা আগেই জেনেছি ডেঙ্গু জ্বর দুই ধরনের হতে
পারে তাই চলুন আমরা এবার আলাদা আলাদা করে দুই ধরনের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ গুলো
জেনে নিই।
আরো পড়ুনঃ পাইলসের ঘরোয়া চিকিৎসা
ক্লাসিকাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণঃ Classical ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে শরীরের বেশ
কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায় যেমন - তীব্র জ্বর (১০৪-১০৫ ডিগ্রি প্রায়) , জ্বরের
সাথে বমি , পেট ব্যথা , মাথাব্যথা , কোমর ব্যথা , জয়েন্টে
ব্যথা, কোমরে ব্যথা , চোখের পেছনে ব্যথা। ক্লাসিকাল ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে হারে
এতই ব্যথা হয় যেন মনে হয় হাড় গুলো ভেঙ্গে পড়ছে । এই কারণে ডেঙ্গু জ্বরের আরেক
নাম 'ব্রেক বোন ফেভার '। এই জ্বরের কারণে অনেক সময় শরীরে ও তকে রেসের মতন
এলার্জি দেখা দিতে পারে এবং এখনো কখনো কখনো চুলকানির কারণ হতে পারে।
হেমোরেজিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণঃ হেমরিজিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর অত্যন্ত মারাত্মক,
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো হেমোরেজিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের সাথে অনেক মিল
থাকে তবে পার্থক্য এটুকুই মোরেজিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের সাথে রক্তক্ষরণ হতে পারে,
রক্তক্ষরণ বিশেষ করে মাড়ি ও নাক দিয়ে বেশি হয়। রক্ত জমাট বাঁধা , পায়খানার
সাথে কালো রক্ত যাওয়া , হাই হাইপোভালিউমিক শকে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
আর এ ধরনের মৃত্যুকে ডেঙ্গু শখ সিনড্রোম বলা হয়।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা
চলুন এবার ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। যদিও এখন পর্যন্ত
ডেঙ্গু জ্বরের কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি, তাই ক্লাসিক্যাল ও
হেমরেজিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ এবং উপসর্গ দেখে এর চিকিৎসা করা হয়।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে সেরে যায় তাই জন্য
এর উপসর্গ গুলোর ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের মেডিসিন প্রয়োগ করা
হয় যেমন- ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল , বমির জন্য
সিসটিমিটিল এই জাতীয় ওষুধগুলো রোগীকে খেতে বলা হয় এবং সাথে সাথে প্রচুর
পরিমাণে পানি এবং তরল জাতীয় খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
আরো পড়ুন ঃ মুখের দুর্গন্ধ দূর করার উপায়।
অপরদিকে হেমোরেজিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের জন্য রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় কারণ
হেমোরিজিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর অত্যন্ত মারাত্মক। এরপর প্রতিদিন রোগীর প্লেটলেট
কাউন্ট এবং পি সি ভি পরীক্ষা করানো হয়। হেমোরেজিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে রোগীর
প্লেটলেট কমে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। প্লেটলেট কাউন্ট যদি ১০ হাজারের
নিচে নেমে যায় তাহলে রোগীকে শিরাপথে প্লেটলেট ট্রান্সফিউশান করতে হয়। আর যদি
রোগীর প্রত্যক্ষ রক্তক্ষরণ হয় তাহলে রোগীকে রক্ত দিতে হয়। তবে ভুলবশত কোন
কারনেও ডেঙ্গু জ্বরের রোগীকে এস্পিরিন জাতীয় ওষুধ দেওয়া যাবে না কারণে জাতীয়
ওষুধগুলো রক্তক্ষরণের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। আশা করছি ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা
সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন।
ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয়
ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয় বিষয়গুলো এবার আমার জানতে হবে , কারণ ডেঙ্গুর জ্বর
যেহেতু সুনির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই তাই জন্য এই ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয়
বিষয় সম্পর্কে জানা থাকলে ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ করতে আমাদের অনেকটা সুবিধা হবে।
তাই চলুন এবার ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয় বিষয় সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। ডেঙ্গু
জ্বরে আক্রান্ত হলে আমাদের প্রধান করণীয় হচ্ছে , দ্রুত চিকিৎসকের কাছে
গিয়ে ডাক্তারি পরামর্শ গ্রহণ করা এবং ডেঙ্গু জ্বরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা
গ্রহণ করা। এই জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গুলো আমরা নিতে পারি,
- যেহেতু এটি মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বর ছড়ায় তাই বাহক মশার দমনই ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের প্রধান উপায়।
- বাসা বাড়িয়ে , ফুলের টব , ব্যবহৃত কৌটা , নারিকেলের খুলি , গাড়ির টায়ার ইত্যাদি এক কথায় বলতে গেলে যেসব স্থানে পানি জমে থাকার আশঙ্কা থাকে সেই স্থানগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে যাতে এডিস মশা এখানে ডিম না পারতে পারে এবং বংশবিস্তার করতে না পারে।
- ঘরে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে
- এডিস মশা দিনের বেলা কামড়াই , এই কারণে দিনের বেলা ঘুমাতে হলে অবশ্যই মশারি টেঙ্গে ঘুমাতে হবে।
- ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
মন্তব্য, এই প্রশ্নের মাধ্যমে আমরা ভালোভাবে জেনে নিয়েছি ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয়
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ এবং ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা সম্পর্কে। ডেঙ্গু জ্বরের কালো
ধাঁধা ছিনিয়ে নিয়েছে বহু মানুষের জীবনে। যা চিকিৎসা বিজ্ঞানের সফলতার যুগের
কারো কাম্য নয়, তাই ডেঙ্গু জ্বরের কারণে যাতে কারো আর অমূল্য জীবন নষ্ট না হয়ে
যায় সে ব্যাপারে সচেতন থাকুন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url