চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ - চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের উপায়
সম্প্রতি যে রোগটি জাতীয় জীবনে আতংকের সৃষ্টি করেছে সেটি হলো চিকুনগুনিয়া
(Chikungunya). CHIKV- নামক ভাইরাসের সংক্রামনণ থেকে মানব শরীরের অস্থিগ্রন্থিতে
প্রচন্ড ব্যথাসহ তীব্র জ্বরকেই চিকুনগুনিয়া বলে। এটি রোগীর জন্য তীব্র
যন্ত্রণাদায়ক বলে রোগী অনেক সহজেই দুর্বল হয়ে পড়ে।আজকে আমরা বিস্তারিতভাবে
জানবো চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের উপায় এবং চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ।
চিকুনগুনিয়া রোগ সম্পর্কে জেনে রাখা উচিত কেন না এই রোগ হলে রোগীকে অত্যন্ত
দুর্বল হয়ে পড়তে হয় এবং যার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। তাই চলুন এই
পোষ্টের মাধ্যমে চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের উপায় ও চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ
সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। ২০০৮ সালের দিকে বাংলাদেশের রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ
জেলায় প্রথম এই রোগ ধরা পড়ে। পরবর্তী সময় ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে এই রোগ লক্ষ করা
গেলেও এরপর এই ভাইরাসের কথা তেমন ভাবে শোনা যায়নি। তবে ২০১৭ সালে এটি ঢাকাসহ সারা
দেশে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। এডিস এলবোপিকটাস (Adese Albopictus) ও এডিস ইজিপ্ট
(Adese Eagypti) মশা চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের বাহক।
সূচিপত্রঃ চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের উপায় - চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ
- চিকুনগুনিয়া কি
- চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল
- চিকুনগুনিয়া যেভাবে ছড়ায়
- চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ
- চিকুনগুনিয়ার জ্বরের উপসর্গ
- চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়
- চিকুনগুনিয়া জ্বরের চিকিৎসা
- চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের উপায়
চিকুনগুনিয়া কি
চিকুনগুনিয়া একটি জ্বরের নাম। 'চিকুনগুনিয়া' শব্দটি ম্যাকোন্ডা নৃগোষ্ঠীর
মাতৃভাষা কিমাকোনডে (Kimakonde) নামক ভাষার একটি শব্দ। যা ওই ভাষার মূল
ক্রিয়া 'কুনগুনিয়ালা' (Kungunyala) হতে সৃষ্টি। এটি সোয়াহিলি ভাষার একটি
উপভাষা। বাংলায় চিকুনগুনিয়া শব্দের অর্থ 'বাঁকা হয়ে যাওয়া' বা 'গ্রন্থি
ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া'। এই জ্বর হলে শরীরের হাড়ের জোড়াগুলো ফুলে বাঁকা হয়ে
যায়। তাই ম্যারিয়ন রবিনসন (Marion Robinson) জ্বরটির নাম দিয়েছেন
'চিকুনগুনিয়া'।চিকুনগুনিয়ার উদ্ভব হয় ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের তানজানিয়ার
দক্ষিণাঞ্চলে ম্যাকেন্ডে মালভুমি এবং মোজাম্বিক ও টাঙ্গানিকার সীমান্ত এলাকায়
এই জ্বর ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। এর তিন বছর পর ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ম্যারিয়ন
রবিনসন (Marion Robinson) ও ডব্লিউ. এইচ. আর. লামসডেন (W.H.R Lumsden) প্রথম
এই জ্বরের কারন ও ভাইরাস আবিষ্কার করেন। চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব সাধারণত
এশিয়া ও আফ্রিকাতেই দেখা যায়। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে এটি ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে
পড়ে। ২০১৪ সালে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়।
চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল
অন্যান্য ভাইরাসের মতোই ভেজা, পূতিগন্ধময় ও স্যাঁতসেঁতে জায়গায় CHIKV ভাইরাস
জন্ম নেয়। বিশেষ করে এডিস মশার বসবাসস্থলে এ ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে
লক্ষণীয় বিষয় হলো, এডিস মশা অন্যান্য মশার মতো ময়লা পানি ও আবর্জনায় তেমন
বসবাস করে না। এরা সাধারণত সচ্ছ পানি ও বাড়ি ঘরের কাছাকাছি গাছপালায় বসবাস
করে। বিশেষ করে এরা ঘরের ফুলের টবে এরা ছড়িয়ে থাকে। CHIKV ভাইরাসের সাধারণ
উৎপত্তিস্থল হিসেবে বাড়িঘরের নিকটবর্তী পচনশীল লতাপাতা, পরিত্যক্ত টায়ার ও
নারিকেলের খোসায় জমে থাকা পানি, নালা, ডোবা, নর্দমা, গোবর, টয়লেট প্রভৃতি
স্থানকে চিহ্নিত করা যায়।
চিকুনগুনিয়া যেভাবে ছড়ায়
চিকুনগুনিয়া হলো CHIKV ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রমণ। প্রাথমিকভাবে CHIKV
ভাইরাসে আক্রান্ত এডিস আলবক্কটাস অথবা এডিস ইজিপ্ট মশার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়া
ছড়িয়ে পড়ে। এধরনের মশা সাধারণ সকালবেলায় বা দিনেরবেলায় কামড়ায়। এছাড়া
চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ করলে এবং ল্যাবরেটরিতে নমুনা
পরীক্ষার সময় অসাবধানতায় এ রোগ ছড়াতে পারে। এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশের দুই
থেকে চার দিনের মধ্যে আকস্মিক জ্বর শুরু হয় এবং এর সঙ্গে দেহের
অস্থিগ্রন্থিতেও তীব্র ব্যথাও শুরু হয়। সে ব্যথা কয়েক সপ্তাহ, মাস এমনকি বছর
পর্যন্তও স্থায়ী হতে পারে। চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুর ঝুঁকি অতি বিরল। তবে
বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই রোগের জটিলতা তুলনামূলক বেশি হয়। মানুষ ছাড়াও বানর,
পাখি, ইঁদুর প্রভৃতি তীক্ষ্ণ দন্তধারী প্রাণীর মধ্যে CHIKV ভাইরাসের জীবনচক্র
বিদ্যমান।
চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ
এডিস মসাবাহিত হওয়ার কারনে চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ গুলো অনেক সময়
ডেঙ্গুর সাথে মিলে যায়। ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া রোদ দুটোকে আলাদা করার জন্য
চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা দরকার। আপনাদের মধ্যে
অনেকেই চিকনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ সম্পর্কে আবগত নন এবং তাই অনেকেই
চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ গুলো জানেন না। তাই আজকে আপনাদের সঠিকভাবে জানার
চেষ্টা করব চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ গুলো।
সাধারণ জ্বর বা ডেঙ্গু জ্বরের সাথে সাদৃশ্য থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে
চিকুনগুনিয়া একটু ভিন্ন রকম হয়। সাধারণ এডিস মশা কামড়ানোর তিন থেকে দশ
দিনের মধ্যে এই জ্বরের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। আবার অনেক আক্রান্ত হলেও
কোন কোন উপসর্গ প্রকাশ পায় না। এই রোগটি সাধারণত আকস্মিক অস্থিগ্রন্থিতে
প্রচন্ড ব্যাথার মাধ্যমে শুরু হয় ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে থেকে তীব্র অসুস্থতা
ও হতে পারে। তীব্র অসুস্থতার পর্যায়কে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।
আরো পড়ুনঃ ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
প্রথম ধাপে
পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে এই ভাইরাস রক্তে প্রবেশ করে। দ্বিতীয় ধাপে
স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারকারী পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ পর্যায়ে পরীক্ষার মাধ্যমে
ভাইরাস রক্তে সনাক্ত করা যায় না। শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ রোগটি
হঠাৎ শুরু হয়- যে সাত দিন বা ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। জ্বর সাধারণত ৩৯°
সে. (১০২° ফা.) বা মাঝে মাঝে ৪০° সে. (১০৪° ফা.) পর্যন্ত হয়ে থাকে। রক্তে
ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে শরীরের জ্বর আসে এবং রক্তে ভাইরাসটির মাত্রা
যতই তীব্র পর্যায়ে পৌঁছায় রোগের লক্ষণ গুলো তীব্রতা ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
চিকুনগুনিয়ার জ্বরের উপসর্গ
চিকুনগুনিয়ার প্রথম লক্ষণই হলো হঠাৎ করে শরীরের উচ্চ তাপমাত্রায় জ্বর আসা।
তাপমাত্রা অনেক বেড়ে ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। এ জ্বরের কোনো কাপুনি
বা ঘাম হয় না। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে তীব্র
গ্রন্থিও শুরু হবে। প্রথমে শুধু হাত-পা দিয়ে শুরু হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে
পড়ে। অসহ্য ব্যথায় রোগী হাঁটতে পারে না ও সামনে ঝুঁকে যায় বা বেঁকে যায়।
জ্বর চলে যাওয়ার পরও কয়েকদিন এই ব্যথা থাকতে পারে। এ রোগের শুরুতেই
শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। অনেক সময় জ্বর শুরু হওয়ার ২ থেকে ৩ দিন পর জ্বর
কমতে শুরু করলে ফুসকুড়ির লক্ষণ দেখা যায়। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত
হলে অনিদ্রা বা ঘুম কম হতে পারে জ্বরের সঙ্গে ও প্রচণ্ড মাথাব্যথা থাকতে
পারে। চিকুনগুনিয়া জ্বরে রোগী অনেক দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে রোগীর
বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর চোখ লাল হয়ে
চোখের ব্যথা এতটাই বেড়ে যায় যে আলোর দিকে তাকালে চোখ জ্বালা করে।
চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়
উপরিউক্ত উপসর্গুলো দেখা দিল ওই ব্যক্তির চিকুনগুনিয়া ভাইরাস দ্বারা
সংক্রামনের আশংকা থাকে। উৎসর্গগুলো এক সপ্তাহের মধ্যে চিকনগুনি আক্রান্ত
ব্যক্তির রক্তের ভাইরাসটি (Serology Ges এবং RT-RCT) পরীক্ষার মাধ্যমে
শনাক্ত করা যায়। বাংলাদেশ রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে
চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়ের সকল পরীক্ষা করা হয়
চিকুনগুনিয়া জ্বরের চিকিৎসা
এখন আপনাদের জানাবো চিকুনগুনিয়া চিকুনগুনিয়া জ্বরের চিকিৎসা
সম্পর্কে।চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা মূলক উপসর্গ ভিত্তিক। এ
জ্বরের নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম নিতে হবে,
প্রচুর পানি পান ও জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনের জ্বর ও ব্যথার
জন্য চিকিৎসা পরামর্শ অনুযায়ী প্যারাসিটেমল ট্যাবলেট খাওয়া যেতে পারে
এছাড়া গ্রন্থি ব্যথার জন্য গিটের উপর গরম পানির সেঁক উপকারী হতে পারে।
আরো পড়ুন ঃ মুখের দুর্গন্ধ দূর করার উপায়।
তবে
প্রাথমিক উপসর্গ ভালো হওয়ার পর যদি গ্রন্থি ব্যথা ভালো না হয় তবে দ্রুত
পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেতে হবে। বস্তুত এই রোগের অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে কোন
উপকার নিয়ে। বরং অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দীর্ঘ মেয়াদী
সমস্যা তৈরি হতে পারে । তাউ চিকুনগুনিয়া উপশমে প্রচুর পরিমাণে পানি পান
করার পাশাপাশি ডাবের পানি, স্যালাইন, লেবুর শরবত প্রভৃতি গ্রহণ করাই
নিরাপদ।এগুলোই হলো চিকুনগুনিয়া জ্বরের চিকিৎসা।
চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের উপায়
আপনি কি চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জানেনে? যদি না জেনে থাকেন
তাহলে অবশ্যই চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের উপায় জেনে রাখা জেনে দরকার। চলুন
এবার তাহলে জেনে নেওয়া যাক চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের উপায়। চিকিৎসার চেয়ে
প্রতিরোধই চিকনগুনিয়া থেকে সুরক্ষা পাওয়ার উত্তম পন্থা। কেননা
চিকনগুনিয়া ভাইরাস প্রতিষেধক কার্যকরী কোনো টিকা এখনও আবিষ্কার হয়নি। এটি
যেহেতু এডিস মশা বাহিত রোগ তাই মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ
করা যেতে পারে । যেমন
- ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশাই টানিয়ে ঘুমানো
- লম্বা হাতাযুক্ত জামা ট্রাউজার পড়ে থাকা
- বাড়ির চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা
- বাড়ি ও বাসার কোনো পাত্রে পানি জমাতে না দেওয়া ইত্যাদিশুধু স্ত্রী জাতীয় মশার কারণে চিকুনগুনিয়ার জ্বর হয়।
- স্ত্রী জাতি মশা দিনের বেলায় কামড়ায় এবং একের অধিক মানুষকে কামড়াতে পছন্দ করে তাই মশারী টানিয়ে ঘুমাতে হবে।
মনে রাখতে হবে এডিস মশার ডিম পানিতে এক বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। বালতি,
ফুলের টব, গাড়ির টায়ারপ্রভৃতি স্থানের জমে থাকা অল্প পানিও এডিস মশার ডিম
পরিস্ফুটনের জন্য যথেষ্ট। এডিস মশা স্থির পানিতে ডিম পাড়ে। তাই বাড়ির
আশেপাশে যেন কোন পানি জমে না থাকে তা লক্ষ রাখতে হবে। আশা করছি চিকুনগুনিয়া
প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন।
মন্তব্য, আশা করছি চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ এবং চিকুনগুনিয়া
প্রতিরোধের উপায় গুলো জেনে আপনি উপকৃত হয়েছেন।এই পোস্টের মাধ্যমে শেয়ার করা
তথ্য গুলো যদি ঠিক মতন অনুসরন করেন আপনাকে ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া রোগ
থেকে নিরাপদে রাখতে সাহায্য করবে।সুস্বাস্থ্য আমাদের সকলেরই কাম্য।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url